Friday, 18 October 2013

জলের উপত্যকায় --রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

বড়ো অসময় এসে তুমি স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাও
বড়ো অসময় এসে বোসে থাকো অচেতন ভুবনে।
তোমাকে বোঝার আগেই তুমি বোধের উৎসে
নতজানু প্রার্থনার মতো ধুপে ও লোবানে জড়াও
কোমল বিন্যাস

তোমাকে ছোঁবার আগেই তুমি অস্পর্শতায় ফিরে যাও!

তুমি নিশব্দ গমনে এসে দেখে যাও আমার পৃথিবী
সৌরসাগরে ভাসে মৌগুমি দীঘল জাহাজ,
কোন আলোকবর্ষে তোমায় দ্বিতীয় প্রেমের মতো
বুকে নেবো অনিদ্র বেদনার কোমল আঘাতে?

তোমাকে ডাকার আগেই তুমি প্রতিধ্বনিতে বেজে ওঠো
দূরের পাহাড়ে তোমার শরীরের শূন্যতা ঘিরে
ভাসমান ধ্বনির নৌকো ফিরে যায় বিষাদ নীলিমা।

অসময় করাঘাতে ভেঙে যায় কবাটের ঘুম,
জলের উপত্যকায় নতজানু বাতাসের মতো
উম্নোচন বুকে এলে কি প্রবোধে ফেরাবে আমায়?

অসময়ে এসেছো বোলে অসময় হয়েছে সময়
বেদনায় এসেছো বোলে বেদনাই তীর্থ আমার।।

২৫.০৯.৭৫ লালবাগ ঢাকা

পান করো রাত্রি -রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

শেষ অব্দি মেঘগুলো বৃষ্টি হলো দ্যাখো-
আমি তোমাকে বলতে পারতাম,
জল, বাষ্প আর আর্দ্র বাতাসের কথা।
সূর্যাস্তের আগে
মেঘেরা পেখম মেলে
ছুঁয়ে দ্যায় প্রজাপতির ডানার তন্ময়তা
তোমাকে বলতে পারাতাম দ্রাক্ষরস আর
অফুরন্ত উল্লাসের কথা।
আমি স্পর্শের শিশির হয়ে ঝ’ড়ে
আঙুলে,চুলে ও চিবুকের
সরল নিসঙ্গতায়
হতে পারতাম অন্তরঙ্গ উদাসিনতার ঘ্রান।
একটি ওষ্ঠের ফুল
ছুঁয়ে থেকে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দিয়েছি-
আমি তোমাকে বলতে পারতাম
বৃক্ষ-স্বভাবের কথা।
পুষ্প,রেনু ও প্রজাপতির কথা।
কিছুই বলিনি।
আমার হাতের পেয়ালায়
না, দ্রাক্ষার রস নয়
ভরা ছেলো মানুষের রক্ত
এতো মৃত্যু দিয়ে বোনা হচ্ছে সভ্যতার রঙিন শিখর!
এতো ঘাম দিয়ে
সভ্যতা সাজাচ্ছে
তার মখমল চুড়া!
পেয়ালা উপচে পড়ে কষ্ট।
তুমি পান করছো না কেন?
কেন সব অনর্থক বেলুন উড়িয়ে হয়ে আছো
নিমগ্ন পাথর?
তুমি পান করছো না সখি?
উপচে পড়ছে
নুয়ে পড়ছে সাহস
শেষ সীমানায় এস পেছনে দেয়াল।
গ্লাস উপচে পড়ছে-
তুমি পান করছো না কেন রাত্রি??
২৯.১০.১৩৯৫ রাজাবাজার ঢাকা।

বেহুলার সাম্পান ---রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

তোমাকে পাবার প্রস্তুতি আনে বোধ,
দুঃখকে তাই শাসাই রুক্ষ স্বরে,
বেদনাকে তাই মোড়াই কাফনে শাদা--
তোমাকে রাখার পরিসর গড়ি প্রানে।

মন্বন্তরে অন্তরে যতো ক্লেদ,
মৃত সবুজের যতো পরাজিত বোঝা,
যতো পুরাতন পচনের ঝুলকালি,
ঝেড়ে মুছে কিছু করি তারে উজ্জ্বল।

কিসের এমন প্রেরনা পেয়েছে মন
নষ্ঠ আঁধারে শ্রেষ্ঠ বাসনা খোঁজে।
বুকের অসুখে সুখের স্বপ্ন লিখে
ঘন দুর্যোগ-
তবু সে ভাসায় বেহুলার সাম্পান...

তোমাকে পাবার প্রস্তুতি বাড়ে বোধে
তোমাকে পারা প্রেরনায় জাগি রাত।
নৈরাজ্যের খড়গের তলে মাথা,
ঘাড় কাত কোরে তবু দেখি রোদ
কতোটা পেরোলো অমা।।

[১২.০৩.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা]
:::kBR:::

পুড়িয়ে দেবো নীল কারুকাজ ....রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

বুকের ভিতর লুকিয়ে আছে তীব্র আগুন
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।

রুপেল পালক গুটাও এখন
কৃত্রিমতার নীল কারুকাজ
জঠর জ্বালায় পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।

স্বপ্ন-বিলাস ছড়িয়ে আছো চতুর্দিকে,
ফসল ক্ষেতে খেলছে তোমার সোনার মৃগ,
অবক্ষয়ের ধুসর পোশাক অঙ্গে আমার
অন্ধকারের বিরাট পাখায় আড়াল-করা গেরস্হালি,
উঠোন জুড়ে উজান হাওয়ার দীর্ঘনিশাস।

সাপের ফনায় হাত রেখেছো
হাত রেখেছো বাঘের গায়ে-
ঘরে তোমার লালিত সুখ, আজম্ম সাধ
পুড়িয়ে দিবো, পুড়িয়ে দিবো, সতর্ক হও।

মাটির প্রতি অনুর্বরা আঙুল রেখে
মেঘের অর্থ অনাবৃষ্টি বুঝালে হায়।
শীতার্ত বুক, শীতল শোনিত,
রোদ্দুরকে বল্লে তোমরা জটিল আঁধার।

মাটিতে এক মাতাল যুবক আগুন হাতে
ভীষন খেলায় মত্ত এখন খামখেয়ালি
উল্টো হাতে ঘোরাচ্ছে তার তীব্র লাটিম-

সুখের বাগান,যুক্তিবিহীন খেলনা পুতুল
রেশমি আদোল, মেদাবৃত নিতম্বদ্বয়
হলুদ রাতে ন্যাংটা উরুর খেমটাপনা
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।

বুক পকেটে আতপ চালের সোঁদা গন্ধ
কোথায় যাবে- নহরি ধান টানছে তোমায়।
কাকের পালক, গঙ্গা ফড়িং, বাউল বাতাস
হরগাজাবন গেরস্হালি,
চোখের ভেতর লোনা সাগর, খয়রি শালিক
মাছরাঙা বিচিত্র রঙ-কোথায় যাবে?
আঙ্গিনাতে লাউয়ের জাংলা টানছে তোমায়।

রুপেল পালক গুটাও এখন
গুটাও কৃত্রিমতার ফানুস, নীল কারুকাজ
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।।

০৯.বৈশাখ ১৩৮২ লালবাগ ঢাকা
.....:::kBR:::.....

শোধবোধ-রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আমারও ইচ্ছে করে ঝড়ের সন্ধায়
অন্য কোনো তরুনীর হাত ধ’রে সুদূরে হারাই
বৃষ্টি ও বাতাসে মেলি
যুগল ডানার স্বপ্ন।
আমারও ইচ্ছে করে ফুটে থাকি অসংখ্য শিমুল।
দুপুরের রোদে পোড়া চিবুকের উদাসিন তিল
ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে ভালোবাসা, নীল চোখ,
চাঁদের শরীর-
আমারও ইচ্ছে করে আঙুল জড়াই মিহি স্মৃতি
স্বপ্নের কপাল থেকে
ঝ’রে পড়া চুলগুলো আলতো সরাই
আমারও ইচ্ছে করে নগরের নিয়ন্ত্রিত পথে
সমস্ত নিষেধ মানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
উড়িয়ে চুলের মেঘ দুইজন
সড়কের মাঝখান বেয়ে হেঁটে যাই-
আমরাও ইচ্ছে হয় কাঁদি।
আমারও ইচ্ছে করে খুলে দিই হাতকড়া-বাঁধা হাত
চত্রুান্তের খল বুকে কামড় বসাই।
আমারও ইচ্ছে করে
টুকরো টুকরো কোরে কেটে ফেলি তোমার শরীর।।
০৪বৈশাখ ১৩৯৪ মেথরপট্রি ঢাকা

Monday, 26 August 2013

সাম্যবাদী – কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে
আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব ড়ে যাও, য্ত সখ-
কিন্তু, কেন পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফেরদেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া , জেরুজালেম্, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসিগাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই